ঢাকা মঙ্গলবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫

স্থানীয় ব্র্যান্ড বনাম বিদেশি পণ্য: তরুণদের পছন্দে দ্বিধা ও বাস্তবতা

জিনিয়া তাবাসসুম

প্রকাশিত: ০১ ডিসেম্বর, ২০২৫, ১২:৫৮ দুপুর

জিনিয়া তাবাসসুম

আজকের তরুণ প্রজন্ম এক এমন সময়ে বড় হচ্ছে, যখন কেনাকাটা মানে শুধু প্রয়োজন মেটানো নয়; এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ব্যক্তিগত রুচি, সামাজিক পরিচয়, জীবনধারা, মানসিক স্বস্তি এবং সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার অদৃশ্য চাপ। মোবাইল, স্কিনকেয়ার, পোশাক থেকে শুরু করে ক্যাফের কফি সব ক্ষেত্রেই তরুণদের সামনে আসে পরিচিত প্রশ্ন: স্থানীয় ব্র্যান্ড নাকি বিদেশি পণ্য? এই দ্বিধা আসলে শুধু পণ্যের নয়, বরং ভিন্ন দুই দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন একদিকে দেশের অর্থনীতির ভিত্তি শক্ত করার ভাবনা, অন্যদিকে বৈশ্বিক মান ও আধুনিকতার প্রতি আকর্ষণ।
 
বিদেশি পণ্যের জনপ্রিয়তা দীর্ঘদিনের। মান নিয়ন্ত্রণ, গবেষণা, নিখুঁত প্যাকেজিং ও শক্তিশালী মার্কেটিং এসব কারণেই বিশ্বজোড়া ব্র্যান্ডগুলো মানুষের মনে আস্থা তৈরি করেছে। তরুণদের কাছে এসব ব্র্যান্ড অনেক সময় আধুনিকতা ও স্ট্যাটাসের প্রতীক হয়ে ওঠে। সোশ্যাল মিডিয়া ও ইনফ্লুয়েন্সার কালচার বিদেশি পণ্যকে "কুল" হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে, যা স্থানীয় ব্র্যান্ডের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
 
তবে বাস্তবতা হলো, বাজেট, পণ্যের প্রয়োজনীয়তা এবং সামাজিক চাপের কারণে তরুণদের সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হয় না। দাম–মান–ইমেজ এই তিনের সমীকরণই হয়ে ওঠে সবচেয়ে বড় দোটানা।
 
অন্যদিকে, স্থানীয় ব্র্যান্ডের গল্পও এখন শক্তিশালী। গত এক দশকে বাংলাদেশের বাজারে দেশি ফ্যাশন, স্কিনকেয়ার, টেক, বেভারেজ এবং হোম প্রোডাক্টে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। আমাদের আবহাওয়া, ত্বক, জলবায়ু ও জীবনযাত্রা অনুযায়ী পণ্য তৈরি হওয়ায় এসব ব্র্যান্ডের প্রতি আস্থা বাড়ছে। দাম তুলনামূলক কম হওয়ায় সাধারণ ভোক্তারা সহজেই কিনতে পারে, যা আমাদের অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে মিল রেখেছে। তবে মান নিয়ন্ত্রণ, গবেষণায় কম বিনিয়োগ এবং বড় পরিসরের প্রচারণার অভাবে কিছু স্থানীয় কোম্পানি এখনও প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে থাকে।
 
স্থানীয় পণ্যের আরেকটি সুবিধা হলো সহজলভ্যতা ও বিক্রয়োত্তর সেবা। দেশে তৈরি হওয়ায় পরিবহন ব্যয় কম থাকে, ফলে দামও সাশ্রয়ী। বিপরীতে বিদেশি পণ্যে শুল্ক, পরিবহন ব্যয় ও সীমিত সরবরাহের কারণে দাম বেশি হয় এবং সেবা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তাই বাজেট সচেতন তরুণদের কাছে স্থানীয় ব্র্যান্ডই অধিক যুক্তিযুক্ত মনে হয়।
 
গুণগতমানের ক্ষেত্রেও এখন পরিবর্তন এসেছে। বিদেশি ব্র্যান্ড মানে ভালো এই ভাবনা অনেক সময় সত্য হলেও, স্থানীয় ব্র্যান্ডও দ্রুত এগোচ্ছে। আমাদের প্রয়োজন ও পরিবেশ বিবেচনায় তৈরি দেশি পণ্য অনেক সময় আরও কার্যকর হয়। তরুণেরা এখন আর একতরফা সিদ্ধান্ত নেন না; বরং রিভিউ, ব্যবহারকারীর অভিজ্ঞতা ও টেকসই ব্যবহারের ওপরই বেশি গুরুত্ব দেন।
 
অর্থনৈতিক দিক থেকে ভাবলে বিষয়টি আরও গুরুত্বপূর্ণ। বিদেশি পণ্যের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ বাড়ায়। বিপরীতে স্থানীয় ব্র্যান্ডকে সমর্থন দিলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়, উদ্যোক্তা বাড়ে, শিল্প খাত শক্ত হয় এবং দেশের ভেতরে অর্থের সঞ্চালন হয়। অর্থাৎ একটি দেশি পণ্য কেনা মানে পুরো অর্থনীতিকে শক্ত করার একটি ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
 
পরিবেশ চিন্তায়ও স্থানীয় ব্র্যান্ড সুবিধাজনক। বিদেশি পণ্য দেশে আনতে যে দীর্ঘ পরিবহন ব্যবস্থা লাগে, তা কার্বন নিঃসরণ বাড়ায়। স্থানীয় পণ্যের পরিবেশগত প্রভাব তুলনামূলক কম, এবং অনেক দেশি ব্র্যান্ড পরিবেশবান্ধব প্যাকেজিংয়ের প্রতিও গুরুত্ব দিচ্ছে।
 
তরুণ প্রজন্ম শুধু ভোক্তা নয়, তারা বাজারের ভবিষ্যৎ নির্ধারক। একজন তরুণ যখন একটি দেশি ব্র্যান্ড বেছে নেন, তখন তিনি একটি সম্ভাবনা, একটি উদ্যোক্তা এবং একটি স্বপ্নে বিনিয়োগ করেন। ছোট ছোট এই সিদ্ধান্তগুলোই একদিন দেশি ব্র্যান্ডকে বৈশ্বিক পরিচয়ের দিকে এগিয়ে নেবে।
 
এখন পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। “Made in Bangladesh” লেবেলের প্রতি গর্ব বাড়ছে, এবং অনেক স্থানীয় ব্র্যান্ড আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে উৎপাদন করছে। তবে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নির্ভর করে মান, বিশ্বাসযোগ্যতা ও ব্র্যান্ড ইমেজের ওপর। শুধুমাত্র দেশি বলে মানহীন কিছু গ্রহণ করা যেমন যুক্তিযুক্ত নয়, তেমনি বিদেশি বলে চোখ বন্ধ করে কেনাও বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
 
শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত ব্যক্তিগত হলেও প্রভাব সামষ্টিক।
ভোক্তাকে মান, মূল্য ও দেশের স্বার্থ এই তিনটি ভিত্তি বিবেচনায় নিতে হবে। পাশাপাশি রাষ্ট্র ও উদ্যোক্তাদেরও মান নিয়ন্ত্রণ জোরদার, গবেষণায় বিনিয়োগ এবং দেশি ব্র্যান্ডকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরার মতো পদক্ষেপ নিতে হবে।
 
সচেতন ভোক্তা, সুস্থ প্রতিযোগিতা ও মানসম্মত উৎপাদন এই তিনের সমন্বয়ই ভবিষ্যতের বাজার নির্ধারণ করবে। সিদ্ধান্ত হোক আবেগ নয়, সচেতনতার ওপর।
 
জিনিয়া তাবাসসুম
শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
 
 

Link copied!